বার্গেন হল ফিওরডের প্রবেশ-পথ। পশ্চিম নরওয়ের ফিওরড-ই যে স্ক্যান্ডিনিভিয়া-ভ্রমণার্থীদের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ একথা অনস্বীকার্য। বার্গেন শহরের প্রাণকেন্দ্র হার্বার-অঞ্চল থেকে ফিওর্ড্ ট্যুর করা যায়, আমরা সেই ইচ্ছেতেই গুটিগুটি এগোলাম। কাউন্টারের মহিলা টিকিট দেওয়ার সময় আঙুল তুলে একটি লঞ্চ দেখিয়ে বললেন, চারটের সময় ছাড়বে। তখন ঘড়িতে তিনটে পনেরো, পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাতে সময়, আমরা বাজারে রাস্তায় এলোমেলো ঘুরে বেড়িয়ে পৌনে চারটের সময় এসে দরজার সামনে দু-চারটে মানুষের পেছনে লাইনে দাঁড়ালাম। এবং দাঁড়িয়েই রইলাম, ঘড়িতে এদিকে চারটে বেজে গেল। ব্যাপারটা কি! দরজা খোলার কোনো চেষ্টাই নেই কেন! ইউরোপীয় মানুষেরা ত খুবই সময়নিষ্ঠ, তবে এম্ন অঘটন কেন? অতঃপর প্রশ্ন করে জানতে পারলাম সেটি আদপে আমাদের লঞ্চ নয়। কি কান্ড! আমাদের লঞ্চ গেল কোথায়? কাউন্টারের মহিলা তো হাত দিয়ে এই লঞ্চটিকেই দেখিয়েছিলেন। আমাদেরকে তখন সবাই দেখালো, ওই দেখো তোমাদের লঞ্চ ঘাট ছেড়ে চলে গেল। তাকিয়ে দেখি, দূরে একটি লঞ্চ যাচ্ছে, অনেক দূরে। হায়রে আমাদের এতগুলো ক্রোনার পুরোটাই জলে গেল! ছুট্ ছুট্ ছুট্ কাউন্টারে পৌঁছালাম।
কাউন্টারের মহিলা বললেন - “ লঞ্চ তো তোমাদের ছেড়ে গেছে বাপু, টিকিটটা কালকের জন্য করে দিচ্ছি, তোমরা কাল যেও বরং”।
- আরে না না কাল তো আমরা সকালের ট্রেনেই অসলো ফিরে যাবো, দেখো আমরা ইন্ডিয়া থেকে এসেছি, বার্গেন থেকে ফিওর্ড্ না দেখে ফিরে যাবো?
ভদ্রমহিলা তৎক্ষণাৎ কাউকে ফোন করলেন, তারপর কোনো বাক্যব্যয় না করে অফিসঘর থেকে বার হয়ে আমাদের দুজঙ্কে দুহাতে নিয়ে একটি বাতানুকুল ট্যাক্সিতে ওঠালেন। ট্যাক্সিতে কেন উঠবো! বিপদের ওপর বিপদ! মহিলার কাছে এসে তো আরও মুশকিলে পড়লাম। আমাদের অবস্থা না বুঝেই ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিছে, কতগুল নরউইজিয়ান ক্রোনার আরও খরচ হয়ে যাবে কে জানে! নাহয় ফিওর্ড্ ট্যুরটা নাই করলাম! কিন্তু ভদ্রমহিলা আমাদেরকে কোনোই অবকাশ দিচ্ছেন না কিছু বলার। ট্যাক্সি-ড্রাইভারের সঙ্গে নিজস্ব ভাষায় অনেক অনেক কথা বলে ভদ্রমহিলার সময় হল আমাদের দিকে তাকানোর, বললেন - “ ড্রাইভার তোমাদেরকে একটি পয়েন্টে পৌঁছে দেবে, সেইখানে ‘হোয়াইট লেডি’ নামের লঞ্চ এসে তোমাদেরকে তুলে নেবে, তোমাদের কোনো খরচ নেই, ‘হোয়াইট লেডি’ এই খরচ বহন করবে”। তখন জানতে পারলাম লঞ্চটির নাম ‘হোয়াইট লেডি’, পরে দেখলাম টিকিটেও লেখা আছে।
যাইহোক ট্যাক্সি জর কদমে বেশ অনেকক্ষণ ধরে চলল, প্রায় তিরিশ মিনিট, জনমানবহীন রাস্তা দিয়ে। আমাদের কিন্তু বেশ ভয় হতে থাকলো, এমন জনমানবহীন রাস্তায় দুজন তরুনীকে মেরে পাসপোর্ট ডলার লুট হয়ে যাওয়া আমাদের দেশে এমন বিরাট কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু তারা যতই রুক্ষ হোক, লোক কিন্তু সজ্জন। তাই ড্রাইভার বিনা বাক্যব্যয়ে আমাদেরকে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। এমন ফাঁকা জায়গায় আমরা দুটি মহিলাই শুধুমাত্র দাঁড়িয়ে, কখন লঞ্চ এসে আমাদেরকে তুলে নেবে এই অপেক্ষায়। লঞ্চ যদি না আসে তো হয়ে গেল! ফিরব যে তার কোনো বযবস্থাই নেই, কোনো যানবাহনের চিহ্ন নেই, কোনো ফোন বুথও আশেপাশে নেই, বুথ থাকলে কি হতো তা অবশ্য জানি না।
আমরা শুধুশুধুই দুশ্চিন্তা করছিলাম, দু-চার মিনিটের মধ্যেই লঞ্চ এল, শুধুমাত্র আমাদের দুজনের জন্যই ওই ঘাটে লঞ্চ ভিড়লো এবং আমাদেরকে তুলে নিল। আমাদের ফিওর্ড্ ভ্রমণ অবশ্য কিছুক্ষণ পর থেকে শুরু হল, কিন্তু পুর ঘটনাটি আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ভাবা যায়?
এই ঘটনার অনেকদিন পর, দুই কিংবা তিন বছর আগের একটি ঘ্টনার কথা না উল্লেখ করলে লেখাটি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ট্যুরিজ্ম্ ডিপার্টমেন্ট আয়োজিত কলকাতার সাবেক পুজাগুলি দেখার জন্যে ্বাসে উঠবার আগে তাদের অফিসে বসে আছি, সেই স্ম্য এক যুবক কাউন্টারে এলেন। কাউন্টারের মানুষ এবং সেই যুবকের কথোপকথনে বোঝা গেল, সেই যুবক ত্রিপুরা থেকে এসেছে, কলকাতা শহর দেখার নির্দিষ্ট ট্যুরটি নেওয়ার কথা ছিল তার, কিন্তু সে আসতে কিছু দেরী করেছে, বাস ছেড়ে চলে গেছে – হুবহু আমাদের দশ বছর আগের বার্গেনের হোয়াইট লেডি উপাখ্যান। কিন্তু পরবর্তী ছবি কিন্তু সম্পুর্ণ আলাদা – এই ত্রিপুরা-বাসী যুবক পরদিন সকালে ত্রিপুরা ফিরে যাচ্ছে শুনেও কাউন্টারের ওপরের মানুষ কিছুই করতে পারলো না, নিদেনপক্ষে টাকাতাও ফেরৎ দিতে পারলো না।
এ হেন অবস্থায় বড় বেদনা, বড় আক্ষেপ – আমরা কেন তাদের মত হতে পারি না!!
No comments:
Post a Comment