না বুঝে কাজ করার বিপদ অনেক। কখনও কখনও খুব অ্যাডভ্যাঞ্চারাস হয়ে ফল না বুঝেই কিছু কিছু কাজ করে ফেলি, সোমাকেও করতে বাধ্য করি। ঝক্কিটা অবশ্য সোমাকেই পুরোটা সামলাতে হয়।
আমরা ম্যাকাও-তে 'গ্রেট ব্যরিয়র'-এ যখন গেলাম, বাস থেকে নেমে দেখি, হাজার হাজার মানুষ একটা গেট দিয়ে ছুটে ছুটে ঢুকে যাচ্ছে। কোথায় ঢুকছে তারা কে জানে! ওই হাজার হাজার মানুষের ব্যস্ত ছোটা কিভাবে যেন আমাদেরকেও টেনে নিয়ে গেল। ভেতরে ঢুকে দেখি, অনেক কাউন্টার, বিশাল লাইন, জনগণ হাতে পাসপোর্ট। বহু জিঞ্জাসাবাদের পর জানা গেল, মানুষজন ওপাড়ে চিনে যাচ্ছে। খুব ভালো, আমরাও যাবো। দেওয়ালের ওপাড়ে ঝুহাই (zhuhai), চিনে শহর, গুয়াঙ্গডঙ্গ (guangdong) প্রভিন্স। ভারত থেকে রওনা হওয়ার আগে সোমা আনেক বলেছিল ‘চিনটাও ঘুরে আসা যাক্, আমি মোটেও রাজি হই নি। কিন্তু ম্যাকাওতে ওই অত ভিড়ের মানুষ এবং তাদের প্রবল ঊত্তেজনা দেখে আমিও হঠাৎ খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লাম, মনে হল একবার ওই বিরাট দেওয়াল পার করে ওদিকে গিয়ে শহরটাকে পাঁচ মিনিট দেখে আসি। কিন্তু আমাদের যে ভিসা নেই, আমাদের যেতে দেবে কেন?
সোমার কথা না শুনে দাঁড়িয়ে পড়লাম ভিড়ের পেছনে। কাউন্টারের লোকটিকে সোমা বলল, ‘আমাদের ভাই চিনের ভিসা নেই, আমরা আজই হংকং থেকে এসেছি ম্যাকাও-তে, আজই আবার হংকং-এ ফিরে যাবো, এর মধ্যে আমরা চিন দেশটি একটু দেখে যেতে চাই (যেন মঙ্গলগ্রহ!) লোকটি কিছুই না বলে হেসে আমাদের দু-জোড়া পাসপোর্টে (তখন আমাদের একেকজনের একেক জোড়া করে পাসপোর্ট) ছাপ মেরে ছেড়ে দিল। আমার মুখে দিগ্বিজয়ীর হাসি, আমার বুদ্ধিতেই না হল, ভিসা ছাড়াই কেমন চিনে যাচ্ছি আমরা!
গেট পার হয়ে বিরাট উঠোন চত্বর হেঁটে গিয়ে দেখি, ও বাবা! আরেকটি বাড়ি! সেটি চিনের অধীন, সেখান থেকে ছাড়া পেলে তবেই আমরা ঝুহাই শহরে ঢুকতে পারবো! এখানেও অনেক অনেক মানুষের পেছনে আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম। এই বাড়িটি এবং বাড়ির মানুষজনকে দেখেই কেমন মনে হল চিনে পোঁছে গিয়েছি। সমস্ত কর্মচারিদের মাথায় কদমছাঁট চুল, মুখের মধ্যে কেমন রুক্ষ ভাব, এমন কি মহিলাদের চেহারাগুলিও যেন কেমন কেমন, খুবই কঠোর প্রকৃতির। আমাদের পালা এল যখন, আমাদেরকে কিছুই বলতে না দিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসার অনেক উল্টে পাল্টে পাসপোর্টগুলি দেখল। শেষমেষ তার প্রশ্ন ‘কই, চিনের ভিসা কই’? আরে বাবা, সেটাই তো এতক্ষণ ধরে বলে যাচ্ছি, আমাদের চিনের ভিসা নেই। ‘মানে?’ – সে ত তাজ্জব, এমনটা শোনেইনি কখনো সে। লাঠি-ঝাঁটা মারে নি অবশ্য, একেবারে ফিরিয়েও দেয় নি, দোতলাতে যেতে বলল, সেখানে ভিসা পাওয়া যাবে।
সেখানেও গেলাম সোমার বারণ না মেনে। মহিলা অফিসার তখনই তিনদিনের জন্য চিনের ভিসা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত, কোনোই কাগজপত্র কিছুই চাই না, ভিসা-মূল্যও এমন কিছুই না, ভারতীয় মূল্যে মাত্র ছশো টাকা ছিল ২০০১ সালে। যেই দেখলাম বিষয়টি এত সহজ, অমনি কেমন যেন উৎসাহটি মরে গেল। ভেবে দেখলাম যেহেতু বিকেলবেলাতেই আমাদের হংকং-এ ফিরে যেতে হবে, এবং ম্যাকাওতে আরো কিছু জায়গা তখনও আমাদের যাওয়া বাকি, আমাদের হাতে কুড়ি-তিরিশ মিনিটের বেশি সময় চিনকে দেওয়ার উপায় নেই, অতএব ভিসা নিয়ে লাভ কি!
ফেরার সময় আবার আর এক জ্বালা! ম্যাকাও ইমিগ্রেশন অফিসার আমাদের ঢুকতে দেবে না, আমাদের পাসপোর্টে চিনের ছাপ নেই। অতএব কোথা’ থেকে এলাম আমরা! একবার ম্যাকাওর গেট দিয়ে যখন বার হয়ে গিয়েছি তখন চিনে না গিয়ে ফিরে এলে কি করে হবে? কেউ অমন করে নাকি? আমাদের যে আদপে চিনের ভিসাই ছিল না এবং তা সত্ত্বেও ম্যাকাওর ইমিগ্রেশন অফিসার আমাদের সেদিকে যেতে দিয়েছিল, সেকথা আর কতভাবে বোঝাবো! আসলে তার কাজ তো বাধা দেওয়ার ছিল না, ছাপ মেরে ছেড়ে দেওয়াই তার কাজ একথা আমাদেরই বোঝা উচিৎ ছিল।
লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আমাদের পালা যখন এল কাউন্টারের লোক কিছুই বুঝলো না, চক্ষু-বিস্ফারিত তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর সে অন্য কাউকে ডাকলো, দ্বিতীয়জন ডাকলো আরেকজনকে, এইভাবে কিছুক্ষণ একে অকে ডাকাডাকির পর চতুর্থজন আমাদেরকে একটা ঘরে নিয়ে গেল (এই রে! নিশ্চয়ই দণ্ডনীয় অপরাধ করে ফেলেছি! বন্দি করে রাখবে নাকি!), এবার আমি সোমার কথা না শুনে কাজ করার জন্যে নিজেকে দুষতে লাগলাম। চতুর্থ মানুষটি অবশ্য বেশ বুদ্ধিমান, আমাদের বোকামিটা সহজেই ধরতে পারলো, পুরো গল্প শুনে পাসপোর্টে ছাপ মেরে ছেড়ে দিল। ভাগ্যিস! আমি তো ভেবেছিলাম, আর বোধহয় ছাড়াই পাবো না, ‘না-ঘরকা-না-ঘাটকা’ হয়েই রয়ে যেতে হবে।
blog ta valo hoyeche dekhte. aro lekha post karo, sange chobi o.
ReplyDeletethanx.
ReplyDelete